দানবরূপী কার্গো জাহাজ ‘এম ভি রুপসী-৯। গতকাল রোববার (২০ মার্চ) দুপুর দুইটার দিকে নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ড ধরে কার্গোটি ঠেলে নিয়ে যায় অর্ধশতাধিক যাত্রীবাহী লঞ্চকে। লঞ্চটিতে বেশির ভাগই ছিল শিক্ষার্থী। প্রাণ বাঁচাতে অনেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ৪০ সেকেন্ড পর যাত্রীসহ লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দেয় নদীতে। শিশুসহ ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ১০-১৫ জন যাত্রী সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও বাকীরা নিখোঁজ রয়েছেন। ডুবে যাওয়া আফসার উদ্দিন লঞ্চের যাত্রী শেখ জাকির হোসেন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ জাকির হোসেন বলেন, কার্গো জাহাজটি ঠিক ২ থেকে ৩ হাত দূরে ছিল। এ সময় আমরা কয়েকজন যাত্রী মিলে লঞ্চচালকের কাছে যাই। তাকে বলি কার্গো জাহাজটি লঞ্চের কাছাকাছি এসে পড়েছে। কিন্তু সে ধমক দিয়ে বলে কিছুই হবে না এবং সবাইকে চুপ করতে বলেন। তারপর আমরা লঞ্চ থেকে ঝাঁপ দিই।
গত ৫০ বছরে নৌদুর্ঘটনা ও মৃত্যু
একইভাবে লঞ্চচালকের গাফিলতি ও অবহেলায় ২৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এই ট্রাজেডিতে ৪৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে ঝালকাঠির জেলা প্রশাসন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন ৮১ জন এবং আহত হয়েছেন কয়েক’শ যাত্রী। পুড়ে ছাই হয়ে যায় এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ। মূলত লঞ্চচালকদের গাফিলতি, অবহেলা ও অসচেতনাতার দরুণ নৌপথে এসব লঞ্চডুবির অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ‘কোস্ট বিডি’র গবেষণা। নোঙর বাংলাদেশ নামের এক সামাজিক সংগঠন ও গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রমতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিগত ৫০ বছরে নৌপথে ২ হাজার ৫৭৩টি দুর্ঘটনায় ২০ হাজার ৫১৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ‘কোস্ট বিডি’র গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২১ বছরে দেশের নৌপথে বড় ধরনের ১৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন দেড় হাজারের অনেক বেশি মানুষ। আহত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। আর নিখোঁজ হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। ভৌগোলিক কারণে দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌপথ। দেশে বর্তমানে নৌপথের দৈর্ঘ্য বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে যথাক্রমে প্রায় ৬ হাজার ও ৪ হাজার কিলোমিটার এবং মোট যাত্রীর প্রায় ১৪-১৫ শতাংশ নৌপথে চলাচল করে। অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের তুলনায় সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হওয়ায় যাত্রীদের অগ্রাধিকারে রয়েছে নৌপথ। তবে ঘন ঘন মর্মান্তিক লঞ্চ দুর্ঘটনাগুলো পছন্দের যোগাযোগ ব্যবস্থা নৌপথকে অধিক মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
নৌপথে লঞ্চডুবির সামগ্রিক চিত্র
সরকারি হিসাব বলছে, গত ৪২ বছরের মধ্যে প্রথম ১২ বছর অর্থাৎ ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তুলনামূলক কম ছিল নৌদুর্ঘটনা। এরপর থেকে পর্যাক্রমে বেড়েছে নৌ-দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। একইভাবে নৌপরিবহন দফতরের সংরক্ষিত তথ্য মতে, ১৯৭৬ সালে দেশে কোনো নৌদুর্ঘটনা না হওয়ায় একজন মানুষও মারা যায়নি। তবে ১৯৭৭ সালে পাঁচটি নৌ-দুর্ঘটনায় ২৯ জন, ১৯৭৮ সালে ৭ দুর্ঘটনায় ২০ জন, ১৯৭৯ সালে ৮ দুর্ঘটনায় ৭৩ জন, ১৯৮০ সালে এক নৌ-দুর্ঘটনায় ৪ জন, ১৯৮১ সালে ৩ দুর্ঘটনায় ২০ জন নৌযাত্রী মারা যায়। তবে ১৯৮২ সালে দুটি দুর্ঘটনা ঘটলে লঞ্চের কোনো যাত্রী মারা যাননি। ১৯৮৩ সালে ৩টি দুর্ঘটনায় ২৯ জন, ১৯৮৪ সালে ৫টি দুর্ঘটনায় ৪২ জন, ১৯৮৫ সালে ১২টি দুর্ঘটনায় ৮০ জন, ১৯৮৬ সালে ১১টি দুর্ঘটনায় ৪২৬ জন, ১৯৮৭ সালে ১১টি দুর্ঘটনায় ৫১ জন, ১৯৮৮ সালে ১১টি দুর্ঘটনায় ১০৮ জন নিহত হন। একইভাবে ১৯৮৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ব্যাপকহারে বেড়ে যায় নৌ-দুর্ঘটনার হার। হিসেব অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালে ৫ নৌ-দুর্ঘটনায় ৩২ জন, ১৯৯০ সালে ১৩ নৌদুর্ঘটনায় ১৬৮ জন, ১৯৯১ সালে ১১ নৌ-দুর্ঘটনায় ১৯ জন, ১৯৯২ সালে ১৭ নৌদুর্ঘটনায় ৫ জন, ১৯৯৩ সালে ২৪ নৌ-দুর্ঘটনায় ১৮৩ জন, ১৯৯৪ সালে ২৪ নৌদুর্ঘটনায় ৩০৩ জন, ১৯৯৫ সালে ১৯ নৌ-দুর্ঘটনায় ৪০ জন, ১৯৯৬ সালে ২০ নৌদুর্ঘটনায় ১৪৭ জন, ১৯৯৭ সালে ১০ নৌ-দুর্ঘটনায় ১০২ জন, ১৯৯৮ সালে ১০ নৌ-দুর্ঘটনায় ৯১ জন, ১৯৯৯ সালে ৬ নৌ-দুর্ঘটনায় ১০৪ জন, ২০০০ সালে ৯ নৌদুর্ঘটনায় ৫৫৩ জন, ২০০১ সালে ১৬ দুর্ঘটনায় ৩৩ জন, ২০০২ সালে ১৭ দুর্ঘটনায় ২৯৭ জন, ২০০৩ সালে ৩২ দুর্ঘটনায় ৪৬৪ জন নৌযাত্রী মারা যান। এছাড়া ২০০৪ সালে ৪১ দুর্ঘটনায় ১২৭ জন, ২০০৫ সালে ২৭ দুর্ঘটনায় ২৪৮ জন, ২০০৬ সালে ২৩ দুর্ঘটনায় ৫১ জন, ২০০৭ সালে ১১ দুর্ঘটনায় ২০২ জন, ২০০৮ সালে ২২ দুর্ঘটনায় ১২০ জন, ২০০৯ সালে ৩৪ দুর্ঘটনায় ২৬০ জন, ২০১০ সালে ২৮ দুর্ঘটনায় ১১৮ জন, ২০১১ সালে ২৪ দুর্ঘটনায় ৭৪ জন, ২০১২ সালে ১৪ দুর্ঘটনায় ১৬৩ জন, ২০১৩ সালে ১৩ দুর্ঘটনায় ২২ জন, ২০১৪ সালে ১৬ দুর্ঘটনায় ১২৩ জন, ২০১৫ সালে ২২ দুর্ঘটনায় ১২০ জন, ২০১৬ সালে ৮ দুর্ঘটনায় ৩৫ জন, ২০১৭ সালে ২৫ দুর্ঘটনায় ৪৫ জন নৌদুর্ঘটনায় মারা যান। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, বছরে দুর্ঘটনার হিসাব ৬৩ গুণ বেশি। বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, ২০১৮ সালে ২১ দুর্ঘটনায় ২ যাত্রী মারা যান। এদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, ২০১৮ সালে ১৫৯টি নৌ দুর্ঘটনায় ১২৬ জন নিহত, ২৩৪ জন আহত ও ৩৮৭ জন নিখোঁজ হয়েছেন। পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুসারে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত নৌপথে ৬০১টি দুর্ঘটনায় ৭৭৩ জন নিহত হন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ১৫৯টি নৌদুর্ঘটনায় ১২৬ জন, ২০১৯ সালে ২০৩টি নৌদুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২০ সালে দেশব্যাপী ৭০টি নৌদুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ২১২ জন এবং আহত ও নিখোঁজ হয়েছেন আরও অন্তত ১০০ জন। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ১৭টি নৌদুর্ঘটনায় ৩৭ জন নিহত, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫টি নৌদুর্ঘটনায় ২৫ জন নিহত, মার্চে ১০টি নৌদুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত এবং এপ্রিল মাসে ১৪টি দুর্ঘটনায় ৩৮ জন নিহত হয়েছেন। ২০২২ সাল অর্থাৎ চলতি বছরে ছোট ছোট অনেক নৌদুর্ঘটনা ঘটলেও সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি হচ্ছে গতকাল রোববার (২০ মার্চ) দুপুর দুইটার দিকে নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনা। এ দুর্ঘটনায় অর্ধশতাধিক যাত্রীর মধ্যে শিশুসহ ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বাকীরা নিখোঁজ রয়েছেন। সরকারি বা বেসরকারি জরিপ বলছে, ১৯৭৬ থেকে প্রথম ১২ বছর নৌদুর্ঘটনা কম ঘটলেও তার পরের বছরগুলোতে বেড়েছে ভয়াবহ নৌদুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার। অর্থাৎ ৫০ বছরে ২ হাজার ৫৭৩টি নৌদুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ২০ হাজার ৫১৪ যাত্রী!। আহত, পঙ্গু, বিকলাঙ্গ এবং নিখোঁজ হয়েছেন অসংখ্য মানুষ।
নৌদুর্ঘটনার মূল কারণ
‘সোসাইটি অব মাস্টার মেরিনার্স’ বিভিন্ন লঞ্চ দুর্ঘটনার গতি-প্রকৃতি এবং তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে লঞ্চ দুর্ঘটনার ১০টি মূল কারণ চিহ্নিত করেছে। কারণগুলো হচ্ছে-অতিরিক্ত যাত্রী বহন (৩৪ শতাংশ) করা, লঞ্চের মাস্টার-চালকের গাফিলতি (১৫ শতাংশ), মাস্টারবিহীন লঞ্চ চালনা (১৫ শতাংশ), চরে আটকানো ও প্রবল স্রোত (৮ শতাংশ), চরে ওঠা (৭ শতাংশ), বিরূপ আবহাওয়া (৭ শতাংশ), নির্মাণজনিত ত্রুটি (৩.৫ শতাংশ), আগুন লাগা, পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদি না থাকা এবং দুটি লঞ্চের সংঘর্ষ। অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল ও যাত্রী পরিবহন সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি বলেন, চালক-মাস্টার-সুকানির অদক্ষতা-গাফিলতির কারণেই নৌপথে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা জানান, প্রতিবছর লঞ্চ দুর্ঘটনার পর কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তদন্তের প্রতিবেদন কখনো প্রকাশিত হয় না। দোষীদের কোনো বিচার হতেও দেখা যায় না। বিচারহীনতার ফলে প্রতিবছরই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে সবাই সচেতন হয়ে নৌযান পরিচালনা করতো আর নৌদুর্ঘটনা কমে যেতো। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল অ্যান্ড ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও গবেষক ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, নৌ দুর্ঘটনার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে শিক্ষার অভাব। যারা নৌযান চালাচ্ছেন তাদের বড় একটি শ্রেণির এই যান চালানোর বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই। ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, বাংলাদেশে চাকচিক্যপূর্ণ নৌযান তৈরি হলেও আধুনিক নৌযান তৈরি হচ্ছে না। হাতেগোনা কিছু নৌযানে নির্মাণ প্রকৌশল ঠিক রয়েছে। তাছাড়া যাত্রীবাহী নৌযানের চেয়ে মালবাহী নৌযানের কারণে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। মালবাহী নৌযানগুলোতে নৌযান পরিচালনার কোনো যন্ত্র নেই; একটি ইঞ্জন ছাড়া। এছাড়া ট্রলার জাতীয় অনেক নৌযান নৌরুট দখল করে আছে যাদের নেই শিক্ষা, নেই আধুনিক সরঞ্জাম বা নিয়মকানুন সর্ম্পকে ধারণা। ফলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বাড়ছেই। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সবুজ শিকদার বলেন, আপনি দেখবেন সনদের জন্য অনেক শ্রমিক আছে যারা ৮-১০ বার পরীক্ষা দিয়েছে কিন্তু সনদ পায়নি। আবার এমনও অনেকে আছেন যারা রাজনৈতিক ও টাকার বিবেচনায় সনদ পেয়ে গেছেন। এরা আসলে শ্রমিক নয়। এদের হাতে দুর্ঘটনা ঘটলেও সব দোষ পড়ে প্রকৃত শ্রমিকদের ওপর। মেসার্স সুরভী শিপিং লাইন্সের পরিচালক রিয়াজ-উল-কবির বলেন, নৌরুটে বিপদের নাম বাল্কহেড। বালুবাহী এই নৌযানের দিনে চলাচল করতে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। এই নৌযানগুলো এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত করতে পারবে না। কিন্তু নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে রাতের অন্ধকারে চলাচল করে বাল্কহেড। এক জেলা তো দূরের কথা, সারা দেশ ঘুরে বেড়ায়। এদের কারণে অধিকাংশ লঞ্চদুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে নৌদুর্ঘটনার হার ৭ শতাংশ
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নৌদুর্ঘটনার হার হচ্ছে ৭ শতাংশ। বন্যা মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নৌদুর্ঘটনার হার বর্তমানে খুবই কম। কেননা এখন ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার সতর্কতা সংকেত দিয়ে ঝড়, তুফান, ঘূর্ণিঝড়ের আপডেট জানিয়ে দিচ্ছে আবহাওয়া অধিদফতর। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অবজ্ঞা করে লঞ্চ চলাচল করে নৌদুর্ঘটনার কবলে পড়ার দায় কার ওপর বর্তাবে তা সহজে বোধগম্য। গবেষকরা বলেন, ধারণক্ষমতার বাইরে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা, মাস্টার-চালকদের অবহেলা, প্রবল স্রোত উপেক্ষা করে যাতায়াত করা, ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন থেকে আগুন লাগা ও বন্যা মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিরূপ আবহাওয়া উপেক্ষা করা নৌদুর্ঘটনার জন্য মূল কারণ। দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবহাওয়া বার্তা সমুদ্রঝড়ের সংকেত দিলেও সেই বার্তা উপেক্ষা করেই নৌ স্টাফরা লঞ্চে যাত্রী বহন করে। ফলে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে নৌপথে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অনেক যাত্রী মারা গেছেন।
নৌদুর্ঘটনায় মামলা ও শাস্তি
দেশের একমাত্র নৌআদালতে বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে মোট ৩ হাজার ৯৬টি মামলা। মামলা হলেও বিদ্যমান আইনের ফাঁকফোকরে প্রভাবশালী আসামিরা বেরিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, নৌদুর্ঘটনা আইনে কঠোর সাজার বিধান না থাকায় দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির পর জড়িতরা লঘু দণ্ড এমনকি অনেকাংশ ক্ষেত্রে ন্যূনতম অর্থ দণ্ড দেয়ার পর পর পেয়ে যায় আসামিরা। নৌদুর্ঘটনায় ভোক্তভোগীদের করা মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, তদন্ত প্রতিবেদনের ত্রুটি, ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আপসসহ আরও বেশকিছু কারণে দোষীরা মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। এমনকি ধনাঢ্য-প্রভাবশালী লঞ্চ মালিক ও শ্রমিক নেতাদের প্রভাবে ৮ বছর ধরে ব্যাহত হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন আইন সংশোধন কার্যক্রম। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন আইনে নৌ দুর্ঘটনার সাজা ১০ বছর প্রস্তাব করা হলেও প্রতিপক্ষের চাপে তা কমিয়ে শাস্তি পাঁচ বছর করা হয়। আর্থিক দণ্ডের পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ এবং ক্ষতিপূরণ রাখা রয়েছে মাত্র ৫ লাখ টাকা। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, দেশে প্রতিবছরই ভয়াবহ লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটছে। লঞ্চ দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির পর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে, পরে কারণ অনুসন্ধানে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু কখনো প্রকাশিত হয় না তদন্তের প্রতিবেদন। আড়লে থেকে যায় দোষীরা। ফলে নৌপথে ঘটছে একের পর এক ভয়াবহ নৌট্রাজেডি।
কলমকথা/ বিথী
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।